সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৬:৫৩ অপরাহ্ন
মো.শাফায়েত হোসেন,বান্দরবান \
বান্দরবানের রুমা উপজেলার পরিচ্ছন্ন গ্রাম মুনলাইপাড়া। রাস্তার দু’ধারের এই গ্রামে, যেদিকে চোখ যায় সবুজের সমারোহ। চারদিকে সাজানো-গোছানো ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ। হরেক রকমের গাছে ফুটে থাকা ফুলের সুগন্ধ সমারোহ যেকারো মন কাড়বে। সম্মিলিত উদ্যোগের কারণেই এমন সুন্দর পরিবেশ তৈরী হয়েছে পুরো গ্রামজুড়ে। রুমা মুনলাইপাড়া এই গ্রামটি ইতোমধ্যেই তিন পার্বত্য জেলায় ‘‘পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর গ্রাম’’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। গ্রামের বাসিন্দাদের প্রত্যয় শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই যেন মুনলাইপাড়ার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। পাহাড় বাসীর মতে, ১৯৮৩সনে ৩০টি বম পরিবার নিয়ে গড়ে উঠে মুনলাইপাড়া। এখন ৬৫ পরিবারের প্রায় ৩শ মানুষের বসবাস। পাড়ার সবাই খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারী। আর খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থে পরিচ্ছন্নতাকে আধ্যাত্মিক বলা হয়েছে। ধর্মের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মিলিত উদ্যোগের কারণে পার্বত্য জেলায় অকল্পনীয় স্বীকৃতি লাভ করেছে বম সম্প্রদায়। তারা মনে করেন, প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনার পরিবেশ দেখে বুঝা যায় রুচির ছাপ রয়েছে প্রত্যেকের। ফুল ও পরিচ্ছন্নতাকে আগলে রেখে পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে অনেক আগেই। প্রতিটি ঘরের সামনে রয়েছে ময়লা ফেলার ডাস্টবিন বা বাক্স। দৈনিক ১০মিনিট নিজ বাড়ি ও আঙ্গিনা পরিষ্কার এবং বর্ষা মৌসুমে অন্তত ১০টি ফুলের গাছ লাগানোর টার্গেট দেওয়া হয় পাড়া পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে।
এদিকে স্বাধীনতার ৫১ বছরের মাথায় বিদ্যুৎ লাইন পেতে যাচ্ছে রুমার মুনলাই পাড়াবাসী। বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ জন্ম বার্ষিকী উদযাপনের সময়কাল ও পাড়া প্রতিষ্ঠার ৪১ বছরে ৬৫ পরিবারের বসবাস মুনলাই পাড়ায় বিদ্যুৎ সঞ্চালনের লাইন সংযোগের বিষয়টি এক অবর্নণীয় সুসংবাদের কথা সবার মুখে মুখে। বৈধভাবে সংযোগ নিতে পাড়ার ৬৫পরিবারের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ পরিবার রিডিংয়ের মিটার নিতে ইতোমধ্যে টাকাও জমা দিয়ে দিয়েছে। তার সাথে চলছে পরিস্কার ও পার্বত্য মন্ত্রী আগমণের প্রস্তুতিও। এসব কথা জানিয়েছে মুনলাই পাড়াবাসী। পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি তাঁর সরকারী সফরে এসে শক্রবার (১১ফেব্রæয়ারী) মুলাই পাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালনের লাইনটি উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিদ্যুতায়ন প্রকল্পের আওতায় লাইনটি দেয়া হয়েছে। মুনলাই পাড়ার মাঝখান দিয়ে বিদ্যুতের খাম্বা ও তার চলে গেছে বগালেক রাস্তায়। লাইনটি থানা পাড়া হতে চুংচয় রেস্টুরেন্ট পর্যস্ত বিস্তৃত। মুনলাই পাড়া প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ও প্রবীন রিয়ালদৌ বম (৭১) বলেন, ১৯৮০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠা করা হয় ৫টি পরিবার নিয়ে। বর্তমানে মুনলাই পাড়ায় ৬৫টি পরিবারের লোকজন বসবাস করছে। রুমা সদর থেকে মাত্র ৫ পাঁচ কিলোমিটার দুরত্ব হলেও এই গ্রামটি বিদ্যুতের আওতায় ছিলনা। এই পাড়া কারবারীসহ দুইজন বিদ্যুত সংযোগের লাইনের জন্য যোগাযোগ করতে গিয়ে এক দালালের খপ্পরে পড়ে ২০ হাজার টাকাও খুঁইয়েছে। ওই টাকা পাড়াবাসী সবার থেকে উত্তোলন করা ছিল। এটি অবশ্য ১০থেকে ১২ বছর আগের ঘটনা। তারপর আর বেশ কয়েক বছর যোগাযোগ করা হয়নি। তবে বিদ্যুতের চাহিদা ও গুরুত্ব বাড়তেই থাকে। এবার বিদ্যুত সঞ্চালনের লাইন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। তাই এটি হবে মুনলাই পাড়া প্রতিষ্ঠার ৪২বছরে। মুনলাই পাড়ার আরেক বয়স্ক বৃদ্ধা রুয়াতজিং বম (৬২), থোয়াইলিয়ান বম (৬৬) এর সঙ্গে। প্রবীন এই দুইজনও ১৯৮০ সালে পাড়া প্রতিষ্ঠা শুরু থেকে ছিলেন। ৪০বছর পরে হলেও বিদ্যুৎ সংযোগ হচ্ছে-এতে কী রকম যে খুশি তা বলতে পারবোনা। বলেন, গ্রীস্মকালে গরমে সিলিং ফ্যান ঝুলবে, ফ্রিজে অনেক কিছু রাখতে পারবো। মন চাইলে ফ্রিজ থেকে নিয়ে তাজা খেতে পারবো। তবে ওইসময় রসলিম ময় বম (২৭) নামে এই নারী বলেন বিশেষ করে রাতেও মেয়েরা তাত বুননের কাজ করার সুবিধা হবে। চুলাই রান্না করলে দেখে থাকতে হয়। এখন রাইস কুকারে ভাত বসিয়ে দিয়ে অন্য কাজও করতে পারবো বলে জানালেন রসলিমময় বম। লমজুয়াল বম(৩৫) বলেন বাসায় বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য মিটারের জন্য এর মধ্যে টাকা জমা দিয়েছেন। বাসায় সোলার প্যানেল থাকলেও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সীমিত আকারে ব্যবহার করতে পারে। তবে বিদ্যুৎ সংযোজিত হলে রঙিন টিভি, ফ্রিজ সহ অনেক কিছু কাজের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের সাহায্যে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে। মুনলাই পাড়া পরিচালনা কমিটি সাধারণ সম্পাদক রবেন বম বলেন, মুনলাই পাড়ায় বিদ্যুৎ সংযোগের পর কোনো পরিবার যাতে অবৈধভাবে সংযোগ না নেয়, এ বিষয়ে পাড়ার মধ্যে কথা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, মুনলাই পাড়ায় ৬৫ পরিবার হয়তো একসাথে মিটার কেনা সম্ভব হবে না, তবে অবৈধভাবে চুরি করে সুযোগ না নিয়ে বাড়ির পার্শ্ববতী বা নিকটতম আত্মীয়ের সাথে যৌথভাবে সংযোগ নেয়া যায় কিনা বিষয়টি ভাববার জন্য পাড়ার সবাইকে বলা হয়েছে।
অপরদিকে রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন শিবলী বলেন, মুনলাইপাড়া বম সম্প্রদায়ের বসবাস, বিশেষ করে তারা দেশের বাহিরে এই ধরনের পরিবেশ দেখে এসে নিজ পাড়ার সুন্দর পরিবেশ ও দূষণমুক্ত রাখেন এবং ধর্মীয় ভাবেও পাড়াবাসী পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করে। সেই জন্য পাড়াবাসীর সম্মিলিত উদ্যোগে তাদের পাড়াকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখেন। দেশের প্রতিটি গ্রাম যেন সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন গ্রাম হয়ে উঠে এমন প্রত্যাশা রাখেন প্রশাসন।
আপনার মতামত দিন